আমজাদ হোসেন শিমুল:
উত্তরাঞ্চলে ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলা রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পশ্চিম-দক্ষিণে প্রমত্তা পদ্মা নদী। এরপরই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। সীমান্ত এলাকার কারণে ১৮৫.১৬ বর্গ কিলোমিটার আয়োতনবিশিষ্ট এই উপজেলার ১২৬ গ্রামের অনেকগুলোতেই ছিল সন্ত্রাসী নানা কর্মকাণ্ড, মাদকের হাট, অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। তবে বাঘা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সাজ্জাদ হোসেনের নিরলস প্রচেষ্টায় মাদক নির্মুল, সন্ত্রাস দমনসহ নানা অপরাধমূলক কার্যক্রম কমে এসেছে। থানা এলাকার জনগণকে নিরাপদে রাখতে ওসি সাজ্জাদ বিট পুলিশিং, কমিউনিটি পুলিশিংসহ বিভিন্ন আলোচনা সভা, সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক, উঠানবৈঠকসহ নানামুখী উদ্যোগের কারণে বাঘা উপজেলার সর্বত্রই যেন এখন শুধুই বইছে শান্তির সুবাতাশ।
মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) দিনব্যাপী বাঘা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- এক সময় হাত বাড়ালেই উপজেলার পদ্মানদীর কোল ঘেষে গড়ে ওঠা গ্রামগুলোতে ফেনসিডিল, গাঁজা, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের ছড়াছড়ি ছিলো। কিন্তু গত বছরের আগস্টের শুরুর দিকে বাঘা থানার ওসি হিসেবে যোগদান করার পর বিগত ১৪ মাসে রমরমা অবৈধ মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে সক্ষম হন সাজ্জাদ হোসেন। এতদঅঞ্চলের জনগণ এখন নির্বিঘ্নে নিরাপদে বসবাস করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে- থানার ওসির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাদকমুক্ত বাঘা উপজেলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিগত ১৪ মাসে মাদকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২৬০টি। এই সময়ের মধ্য উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ১১ হাজার পিচ ইয়াবা, ২ কেজি হেরোইন, ৪ হাজার বোতল ফেনসিডিল, ২ হাজার লিটার মদ, ২০০ কেজি গাঁজা উদ্ধার ও জব্দ করা হয়েছে। রাখছেন। বাঘা থানার ওসির দায়িত্ব নেয়ার পর থানা এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনবার রাজশাহী জেলার শ্রেষ্ঠ অফিসার ইনচার্জ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
সূত্র আরও জানায়, সম্প্রতি (গত ২৯ সেপ্টেম্বর) বাঘার বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বাল্যবিয়ে, ডিজিটাল অপরাধ, ইভটিজিং এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী বিট পুলিশিং সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাঘা থানার ওসি এই সমাবেশকে সারাদেশের জন্য মাইলফলক হিসেবে উপস্থাপনের জন্য গ্রামে গ্রামে গিয়ে করেছেন সভা, স্কুলে স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও করেছেন মতবিনিময়। শুধু তাই নয়; থানায় ওসির কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনসাধারণের সঙ্গে করেছেন বৈঠক। শেষ পর্যন্ত বিট পুলিশিং সমাবেশে ব্যাপক সফলতা দেখিয়েছেন। তার প্রচেষ্টায় ওই দিন বিকালে বাঘার বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ বিভিন্ন পেশার জনসাধারণ দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
প্রায় সাত হাজারেরও বেশি মানুষের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ওই সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন- রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেন। মনিগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য দেন- বাঘা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. সাজ্জাদ হোসেন সাজু। এসময় জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ( ক্রাইম এন্ড অপস) সনাতন চক্রবর্তী, বাঘার আড়ানী পৌরসভার মেয়র মো. মুক্তার আলী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুল, গড়গড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম, বাজুবাঘা ইউপি চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ রন্জু, আড়ানী ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, বাঘা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস সরকার, সাধারণ সম্পাদক মামুন হোসেন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
বাঘা সদর উপজেলার বাসিন্দা মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এক সময় এই বাঘা উপজেলায় মাদকের সহজলভ্যতা ছিল। কিন্তু বর্তমান ওসি মাদকের ব্যাপারে সীমান্ত এলাকায় জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করায় মাদকের ভয়াবহতা থেকে বাঘাবাসী অনেকটা রেহাই পেয়েছে। তিনি ওসি হিসেবে যোগদানের পূর্বে ফেন্সিডিল এই অঞ্চলে ছিল একবারেই স্বস্তা ও সহজলভ্য। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই মাদক নির্মুলে বিশেষ অবদান রাখায় এই ফেন্সিডিল অনেকটাই দুর্লভ। আমরা লক্ষ্য করছি, বাঘা থানায় আগে মাঝেমধ্যেই জমিজমাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিবাদমান দুই গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকতো। কিন্তু বর্তমান ওসি তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সুস্ঠু সমাধান করেছেন। মানুষের নিরাপত্তা বিধানে তিনি রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ১৯৮৩ সালের ২৩ মার্চ বাঘা থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। আমার জানামতে, দীর্ঘ এই সময়ে যতগুলো ওসি এই থানায় দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মধ্যে সেরা ওসি সাজ্জাদ হোসেন। তার নিরলস পরিশ্রম আর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তায় সীমান্তবর্তী বাঘায় এখন শান্তির সুবাতাস বইছে।’
এমন উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাঘা থানার ওসি মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রে যখন পাকিস্তানি বাহিনী এদেশের নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন পাকিস্তানি হায়েনাদের রুখতে প্রথম যে বুলেটটি ছুড়েছিল তা পুলিশ বাহিনী। তখন থেকেই স্বাধীনতার ৫০ বছরেও পুলিশ বাহিনী তাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও এদেশের মানুষকে নিরাপদ রেখেছে। পুলিশ বাহিনীর ওপর মহান যে দায়িত্ব সেই ব্রত নিয়েই বাঘা থানা পুলিশ এগুচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘যখন থেকে আমরা বাঙালি নামে পরিচিত হয়েছি তখন থেকেই উপমহাদেশ তথা সারাবিশ্বে এই বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোলমডেল হিসেবেই পরিচিত। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে এই বাংলাদেশে বসবাস করে আসছে। দীর্ঘ ইতিহাসের পরে যখন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠি আমাদের এই বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে বিষাক্ত করে শোষণ-শাসনের হাতিয়ার চালিয়েছিল ঠিক তখনই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, গণতন্ত্র, আন্দোলন ও স্বাধীনতার বরপুত্র, বাংলার মহানায়ক, বাংলার মুক্তির সনদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সমস্ত ধর্মের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা চির ভাস্বর হয়ে আছে। তার সেই ভাষণে বার বার উজ্জীবিত হই। তিনি প্রিয় মাতৃভূমিকে পাকিস্তানি বাহিনীর শোষণ-নিপীড়ন থেকে মুক্ত করে লাল-সবুজের পতাকা এনে দিয়েছেন। তার সেই ত্যাগের মহিমার কথা মনে-প্রাণে ধারণ করে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা করি। যতদিন বেঁচে থাকবো, দেশ-মাত্রিকার সেবায় নিজেকে সবসময় নিয়োজিত রাখতে চাই।’
এএইচ/এস