ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন ২৭১টি নতুন মোটরসাইকেল

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

রাস্তাজুড়ে বাস, রিকশা, কার, হিউম্যান হলারসহ নানা বাহন। ধারঘেঁষে হাত দেড়েক ফাঁকা জায়গা। ড্রেনের কারণে কোথাও কোথাও আরো সংকুচিত। এটুকুর মধ্যেই চলছে মোটরসাইকেল। ‘ওস্তাদ, বায়ে মোটরসাইকেল’— সহকারীর (হেলপার) এ সতর্কবাণী বাসচালকের কানে না পৌঁছাতেই ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক মোটরসাইকেল। রাজপথ থেকে অলি-গলি, ঢাকার সব সড়কেই একই চিত্র।

গণপরিবহনের স্বল্পতা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, যানজটের ভোগান্তি এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর সুবিধা থাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মোটরসাইকেল। সারা দেশের সড়কগুলোয় প্রতিদিনই বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে শুধু রাজধানীতেই ৩২ হাজার ৫৬২টি নতুন মোটরসাইকেল নিবন্ধন দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংখ্যাটির গড় হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতিদিন ২৭১টি নতুন মোটরসাইকেল নামছে ঢাকার রাস্তায়। অ্যাপভিত্তিক রাইড সেবায় যুক্ত হয়ে দুই চাকার বাহনটির চাহিদা-জনপ্রিয়তা ও সংখ্যা আরো বাড়ছে। তবে ঢাকার মতো ব্যস্ত নগরীতে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধির এ প্রবণতাকে ‘উদ্বেগজনক’ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বাহনটিকে ‘ঝুঁকি’ ও ‘পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী’ উল্লেখ করে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথাও বলছেন তারা।

বিআরটিএর মোটরযান নিবন্ধন তথ্যভাণ্ডারের হিসাব বলছে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ঢাকায় নিবন্ধিত হয়েছে ৩২ হাজার ৫৬২টি মোটরসাইকেল। অর্থাৎ প্রতি মাসে ৮ হাজার ১৪০ আর প্রতিদিন ২৭১টি করে নতুন মোটরসাইকেল নিবন্ধন নিয়েছে। একই সময়ে সারা দেশে নিবন্ধন পেয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৬৯৪টি মোটরসাইকেল। সে হিসাবে দেশে প্রতিদিন ১ হাজার ৫৫টি নতুন মোটরসাইকেল রাস্তায় নেমেছে।

জানুয়ারি-এপ্রিল সময়ে ঢাকা মহানগরে বিভিন্ন ধরনের মোট ৫৬ হাজার ২৫১টি যানবাহন নিবন্ধিত হয়েছে। অর্থাৎ এ সময়ে রাজধানীর সড়কপথে দৈনিক ৪৬৮টি নতুন যানবাহন যোগ হয়েছে। একই সময়ে সারা দেশে নিবন্ধন হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৩৪টি যানবাহন। নিবন্ধন পাওয়া যানবাহনের সিংহভাগই মোটরসাইকেল।

সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, রাস্তা, ফুটপাত এমনকি ভরা বাজারেও ঢুকে পড়ছে মোটরসাইকেল। বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায়ই ট্রাফিক আইন ভাঙছেন চালকরা। ট্রাফিক পুলিশের উঁচানো হাত বা রেলক্রসিংয়ের প্রতিবন্ধক— কোনোটিই মানতে অনীহা বেশির ভাগ বাইকারের। এছাড়া বেপরোয়া চালনা, এক বাইকে তিনজন আরোহণ, হেলমেট না থাকাসহ বিভিন্ন ইস্যু তো রয়েছেই। এসব কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। হচ্ছে অঙ্গহানি, অকালমৃত্যু।

মোটরসাইকেল চালকদের ওপর ভীষণ বিরক্ত ট্রাফিক সার্জেন্ট রফিক। রাজধানীর বাংলামোটরে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের এ সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাস্তায় সবচেয়ে বেশি আইন ভাঙেন মোটরসাইকেল চালকরা। সিগনাল দিয়ে যান চলাচল আটকে রাখলেও তারা ফাঁক গলে বেরিয়ে যান। দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের আটকানো যায় না।

যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আইন না মানার কারণে আমরা প্রতিদিন অসংখ্য মোটরসাইকেল চালকের বিরুদ্ধে মামলা দিই। এসব যানবাহন যেন রাস্তায় বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে, সেজন্য আমরা নিরলস কাজ করছি।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি হাঁটার গতির চেয়েও কম। অপ্রতুল সড়কে যানবাহনের পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি। এমন পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নতুন করে ভাবার পরামর্শ দিচ্ছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, সড়কে বিশৃঙ্খলার কথা বলি বা নিরাপত্তার কথা— সবকিছুর জন্য মোটরসাইকেল হুমকিস্বরূপ। এটা আমাদের গণপরিবহন খাতের জন্য অনেক ক্ষতির কারণ। কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো দেশ মোটরসাইকেলের কারণে সমস্যায় ভুগছে। আমরাও সে পথেই হাঁটছি।

তিনি আরো বলেন, মোটরসাইকেল আটকাতে গেলে ট্রাফিক পুলিশের হাতের নিচ দিয়ে বেরিয়ে যায়, লেভেল ক্রসিংয়ের নিচ দিয়ে চলে যায়। এটা এমন বাহন, যা নিরাপত্তার জন্য হুমকি। অথচ চলতি বছরের বাজেটে মোটরসাইকেলে প্রণোদনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এটা পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্যকে বেসামাল করে তুলবে। পুলিশ কোনো দিনই এদেরকে (মোটরসাইকেল চালক) নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। মোড়ে মোড়ে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে সরকারকে অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা মোটরসাইকেলে নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা বললেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তারা মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধিতে শুধু রাজস্ব আয়ই দেখছেন। যোগাযোগ করা হয় বিআরটিএর পরিচালক (প্রকৌশল) নুরুল ইসলাম বলেন, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন নিবন্ধন সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস। মোটরসাইকেল নিবন্ধন দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো সীমা আমরা বেঁধে দিচ্ছি না। যারাই আসছেন, সবাইকে নিবন্ধন দেয়া হচ্ছে।

ঢাকা শহরে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, আমাদের কাজ হলো মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দেয়া। মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগজনক কিনা, তা বলতে পারব না। এ বিষয়ে অন্য যেসব দায়িত্বশীল সরকারি সংস্থা রয়েছে, তারা ভালো বলতে পারবে।