সাবধানে থেকো বাংলা

পদ্মা বা ভাগীরথী কিংবা ভলগা বা টেমস নদীর দু’পাশে কারা বাস করে? এক ভাষাভাষী মানুষই তো, নাকি একেবারে ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ উড়ে এসে দু’দিকে জুড়ে বসেছে? বাস্তবে দুনিয়ার কোথাও এমনটা ঘটার কথা শোনা যায়নি, ইতিহাস, ভূগোলের সম্পৃক্ততার কারণে সেটা সম্ভবও নয়। সূত্রহারা দূর আবছায়ার কাল থেকে এই-ই হয়ে আসছে। খুব স্বাভাবিক নিয়মে তাই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বিভাজক ইছামতী, পুনর্ভবা, মহানন্দা নদীর দু’পারে আমরা বাঙালিরাই বাস করছি। উত্তর ভারতে গঙ্গা, যমুনার দু’ধারে হিন্দুস্থানিরা আর ইয়াংসি, হোয়াংহোর দু’ধারে চীনারা ঠাঁই করে নিয়েছে। আর সে কারণেই রাজনৈতিক মানচিত্রের ভিন্নতার কারণে এদের পরিচিতি যাই হোক না কেনো, নাফ নদীর দু’পাশে চাটগাঁইয়া ভাষাভাষী একই সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করছে। আর শুধু নদীই নয়, ভূমির সংশ্লিষ্টতাও এর পিছনে বড় নিয়ামকের কাজ করে। আজ যখন মায়ানমারের নেতারা বলেন, রোহিঙ্গাদের সংগে আমাদের ভাষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতির কোন মিল নেই, এরা তাই বৃহত্তর মায়ানমার সমাজের কেউ নয়– বাংলাদেশের লোক, তখন জাতিগত গোঁড়ামি আর উগ্র বর্ণবাদের প্রতাপ ফুটে ওঠে, যুক্তির বদলে সংকীর্ণ চিন্তাভাবনা প্রাধান্য পায়। কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস কি তাহলে মিথ্যা? মোঘল ভারতের অধীনে এই অঞ্চল কি কখনো ছিল না? আমরা কি বলতে পারব, না বলা উচিত যে এদেশের পাহাড়ের লাখ লাখ মানুষ এই একই কারণে আমাদের কেউ নয়! নৈতিকতা আর মানবিকতা বাদ দিলে অবশ্য অনেকে অনেক কিছুই বলে এবং আগামিতেও বলে যাবে।

বেশ ক’মাস হতে চলল কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুটা দেশে-বিদেশে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। নিরাপত্তা পরিষদের দুয়েক জনের ইচ্ছার গ্যাঁড়াকলে পড়ে জাতিসংঘ শুধু কিছু উদ্বেগ প্রকাশ, কঠিন বিবৃতি আর ত্রাণ সাহায্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। হাজার হাজার নীরিহ মানুষকে নৃশংস কায়দায় মেরে আর বর্ণনাতীত নির্যাতনের মুখে লাখ লাখ মানুষকে দেশছাড়া ক’রে এখন খানিকটা চাপে প’ড়ে ফিরিয়ে নেয়ার নামে মায়ানমার নানান অজুহাত আর ফন্দিফিকির করছে। আদতে বাস্তুহারা এই মানুষগুলোকে ফিরিয়ে নেয়ার কোন ইচ্ছাই ওদের নেই। ওদের হয়ে কদিন আগে কাছের একটা পরাশক্তির দূত বলেছেন, রাখাইনের জাতিগত সমস্যাটা খুব পুরনো আর জটিল, তাই এর আশু সমাধান আশা করা ভুল হবে। অথচ দাবীটি সহজ—নিজের মাটিতে ফিরে যেতে চায় ঘরহারা মানুষেরা। আসলে জটিলতা নয়, জাতিগত আগ্রাসন আর স্থানিক স্বার্থপূরণের কুটিলতা থেকেই এই সমস্যা ও দুর্দশার শুরু আর চলমানতা। দেখা যাচ্ছে, অন্য একটা মহল শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে দিনের পর দিন ধরে এদেরকে ভয়ানক সন্ত্রাসবাদী কিংবা ইয়াবা কারবারি সাজাতে ব্যস্ত। তাই খুব কঠিন হলেও সত্যি হলো এই যে, ভূরাজনৈতিক মারপ্যাঁচের কারণে এমন একটা মানবিক বিষয়ে বাংলাদেশ ‘মাইনকার চিপা’য় আটকা পড়েছে।

এদিকে গতকাল পর্যন্ত নিবন্ধনের তথ্য অনুযায়ী উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এগারো লাখ ছাড়িয়েছে। এটা মনগড়া নয়, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাও একাজে যুক্ত আছে। রোজই ওরা আসছে। খুব দুঃখের বিষয় হলেও ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে মাত্র কয়েক বর্গমাইল জায়গার মধ্যে এরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। সদিচ্ছার অভাব কাকে বলে, সে নিয়ে একটু বলি। বাংলাদেশ বেশ অনেকদিন আগেই প্রথম তালিকা হিসেবে মায়ানমারের হাতে ৮,০০০ রোহিঙ্গার নাম দিয়েছিল, ওরা বলছে, ৬৭৫ জনকে ওরা ফিরিয়ে নিতে রাজী আছে, বাকিরা কি তবে আসমান থেকে এ জমিনে নাজিল হয়েছে? ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, বিষয়টা নিয়ে এ দেশকে অনেক যন্ত্রণা আর ধকল পোহাতে হবে, এর শেষ কোথায় তা বলা কঠিন।

এবার নতুন আরেকটা বিপদের কথা বলি। এই বিপদ আসতে যাচ্ছে বন্ধুদেশ ভারতের আসাম থেকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, অসমীয়দের আসার আগে থেকেই ভূমিপুত্র হিসেবে বাঙালিরা সেখানে বসত ফেলেছে। কামরূপ রাজ্যে ছিল তাদের ব্যাপক প্রভাব। ব্রিটিশ শাসনামলে, বাঙালিপ্রধান বৃহত্তর গোয়ালপাড়া, সিলেট আর কাছাড় জেলাকে আসামে জুড়ে দেয়ায় সে প্রভাব আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সে সময় ব্রহ্মপুত্র নদের আশপাশে পড়ে থাকা উর্বর জমি চাষাবাদ করাতে প্রশাসনের মদদে পূর্ববাংলা থেকে লাখ লাখ মানুষকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। আগের বাঙালিদের সংগে মিলে পরে এরা সংখ্যায় বড় আকার নিয়েছে। এটা মেনে নেয়া অসমীয়দের জন্য কঠিন হওয়ায়, বর্ণবাদী লাইন প্রথা চালু করা হয় এবং সেই ১৯৩১ এ-ই শুরু হয়ে যায় ‘বঙ্গাল খেদা’ নামের বর্বর, রক্তাক্ত অভিযান। তখন থেকেই দু’বাংলায় পালিয়ে আসছে আসামের বাঙালিরা। এরপরও থেকে যাওয়া মুসলমান বাঙালি ও শিক্ষা-দীক্ষার অভাব জনিত কারণে এদের জন্মহার বেশি থাকায়, অনেকগুলো জেলায় বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পড়ে আর এটাই এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। উগ্র অসমিয়ারা এদের নাম দিয়েছে, ‘বহিরাগত বাংলাদেশি’। সুতরাং নতুন করে তাড়াও, তা না হলে নাকি ‘বাংলাস্থান’ তৈরি করে ফেলা হবে! ‘জাতীয় নিবন্ধন কর্মসূচি’র নামে শেয়ালকে দেয়া হয়েছে মুরগি পালনের দায়িত্ব, ফলে যা হওয়ার তা-ই হতে যাচ্ছে। অনুমান করা হচ্ছে, কুড়ি থেকে চল্লিশ লাখ মানুষই এর শিকার হবে যার মধ্যে অধিকাংশই খুব স্বাভাবিক কারণেই বাঙালি মুসলমান, হিন্দু বাঙালিও কম থাকবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, আসাম রাজ্য কয়েক যুগ আগে থেকেই বাঙালিদের বসবাসের প্রায় অনুপযুক্ত এলাকা হয়ে উঠেছে, বাঙালি পরিচয়ে একটা চাকরি পাওয়া সেখানে সোনার হরিণ পাওয়ার মতো ব্যাপার। আর কতবার এই বাঙালি নিধনের শিকার হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। নেলির কথা নিশ্চয়ই এখনো অনেকের স্মরণে আছে। তো, বাঙালির এই বধ্যভূমিতে বাংলাদেশের মানুষ এখনো দলবল বেঁধে বাস করতে যাচ্ছে এ তত্ত্ব বিশ্বাস করা একান্তই কঠিন। এছাড়া আসাম আর এর আশপাশের পাহাড়ি রাজ্যগুলোর তুলনায় আর্থসামজিক ও জীবনযাত্রার মানদণ্ডে এদেশ এখন অনেক এগিয়ে। এখানে কর্মসংস্থানের ব্যাপক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, সত্যি বলতে কী উচ্চ মজুরি দিয়েও এখন গ্রাম অঞ্চলে কর্মজীবী খুঁজে পাওয়া যায় না। একাত্তর সালকে এন আর সি-র ভিত্তি বছর ধরে নেয়া হয়েছে, সে বিবেচনায় নিছক পাগল, ভিখারি শ্রেণির লোক ছাড়া আর কারো ওমুখো হওয়ার কথা নয়। এরপরও কথা আছে, বাস্তবে আসামের সংগে বাংলাদেশের সীমান্ত খুব সামান্যই, নদীপথ ছাড়া বাকিটুকু দুর্ভেদ্য তারকাঁটার বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত। দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তে চলছে ব্যাপক টহলদারি। পাহারাদাররা করছে টা কী? এই ফাঁক গলে ফেলানিদের মতো মেয়েরাও তো ছাড় পায়নি। তো, এই কঠিন নজরদারি আর সশস্ত্র পাহারার মধ্যে কোন পাগলে বলে উঠবে, চল ময়না, আসাম যাব .. !

একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, বাঙালির অবস্থা ঘরে বাইরে—সবখানেই আজ প্রশ্নবিদ্ধ। ধর্মের বিভেদ দিয়ে বাঙালির বিভাজন তৈরি করা একান্তই সোজা একটা ফর্মুলা, এই ধর্মের নামেই তাই বাংলায় এখন দাঙ্গা বাধাতে চায় বাইরের লোকেরা। আসামের কথা বাদই দিলাম, ঝাড়খণ্ড, আন্দামানে সংখ্যাধিক্যের পরেও কি বাংলাভাষা, বাঙালি কি যথোচিত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? খোদ পশ্চিম বাংলার অবস্থাও তো তথৈবচ! যাক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। রোহিঙ্গা নামক একটা মানবিক বিপদ এরই মধ্যে আমাদেরকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে, এরপর তৈরি করা নতুন কোন ফাঁদে পড়ার সামর্থ্য আক্ষরিক অর্থেই এ দেশের নেই। বোঝার ওপরে শাকের আঁটি না নেয়ার জন্য তাই এখনই কিছু একটা করা দরকার।

লেখক: যুবায়ের হাসান